বাংলা প্রতিলিপি

 

নারায়ণ চন্দ্র সিনহা (মালিক ও কর্মী, কালি বাইন্ডিং ওয়ার্কস,৭২ বৈঠকখানা রোড,কলকাতা-৯)

বাংলাদেশ থেকে আমরা এসছি ছোটবেলায়। তখন আমার মনে নেই।  আমার বাড়ি হচ্ছিল মেন পায়রাডাঙ্গা। রাণাঘাটের আগে পায়রাডাঙ্গা। ওখানে  মা বাবা থাকত, ভাইবোনরা থাকত।

5/6 পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। তারপরে অভাবের জন্য করতে পারিনি পড়াশুনা। আগে আমি প্রথমে এক জায়গায় চাকরি করতাম। ’ 72 থেকে ’75/’76 পর্যন্ত। তারপরে আমি মোটামুটি কাজ শিখে এই লাইনে নিজস্ব , ’76 থেকে নিজস্ব ভাবে আরম্ভ করি। ঘরটা আমি কারও কাছ থেকে কিনলাম। কিনে নিজেই তারপর নিজেই মেশিন টেশিন কিনে নিজে আরম্ভ করলাম। বাইন্ডিং কাজ বলতে গেলে মানে এভ্রিথিং। প্যাড  বাইন্ডিং  থেকে, খাতা বাইন্ডিং থেকে, লেজার বাইন্ডিং থেকে ডাইরি  বলেন— এভ্রিথিং। ফাইল, অফিসিয়াল  যে ফাইল পত্র সবকিছু। এই যেমন এই জিনিসটা – প্রথমে কাগজটা বড় সাইজে ছেপে এসছে। তারপর ভাঁজ করা হল কাগজটা। কাগজটা ভেজে তারপরে এটাকে ২ টো ফর্মা দিয়ে, ৩ টে ফর্মা দিয়ে ইন্টারলিফ করে পিস  হল। পিস  হলে পর এটার মধ্যে পুস্তানি লাগান হচ্ছে। তারপরে এটাকে কভার মোড়া হবে, স্কুল ডাইরি। একেকটা প্রসেস–  যেমন এই লেজার খাতা, এই যে কাগজ দিয়ে গেল পার্টি। দিলে ওটা ভেজে, সেলাই করে আমাদের যা ফর্মালিটি  আছে সেগুলো করে তারপরে রেডি  হবে।

রোজ তো তাদের কাজ দিতে পারব না আমরা। আর আমাদের জন্য ৫/৭ টা লোক যা আমরা রাখি আমার কাজ থাকলেও পয়সা দিতে হবে, এরা পার্মানেন্ট, আর কাজ না থাকলেও। ১৫ বছর, ২০ বছর ধরে কাজ করে।

ধরুন না — একজন ফুল কারিগর এ লাইনে হলে ১১০ টাকা, ১২০ টাকা। এটা যদি সেলাই হয় – ১৫ টাকা ‘শ। একটা জুত ১৫ টাকা।  নাম্বারিং হয়, হাজার হিসেবে। ৬ টাকা, ৭ টাকা হাজার – নাম্বারিং। সেগুলো সব ফুরনে, সেলাই সব ফুরনে।

কম্পুটার  হয়ে কাজ কমে গেছে। 50%  কাজ কমে গেছে। আমরা আগে মার্কেট এর ক্যাশ লেজার, রেজিস্টার   করতাম, এখন বন্ধের মুখে — সামান্য 1 %। কেননা আজকাল তো খাতাপত্র যে মেন্টেন করে সব কম্পুটার এ সবকিছু।  ক্যাশ মেমো অবধি কম্পুটার এ বেরিয়ে যাচ্ছে। কাজগুলো আগে এগুলো হত…  ব্যাঙ্ক এর লেজার  নাই। এল আই সি –র কাজ করতাম, রেল এর কাজ করতাম। 25%  কাজ আছে।

দপ্তরিপাড়ায়, এর আগে শুনেছি, ৭ হাজার কারখানা আছে। দপ্তরিপাড়ায়, এখানে আমরা শুনেছি আগে যে, ৭ হাজার কারখানা আছে। আর এখন আস্তে আস্তে অনেক কমে গেছে। অনেক, মানে, নতুন নতুন সব মেশিন বেরিয়ে গেছে। আগে যেটা হাতে সেলাই হত সেটা এখন মেশিনে হচ্ছে। পারফেক্ট বাইন্ডিং হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ভাঁজাই মেশিন আছে।  লেবার কমে গেছে। আচ্ছা, তারপরে, এই লাইনে আর পয়সা নাই। লেবাররা যেটুক পাওয়ার উপযুক্ত পয়সা নাই। এ lineএ এখন নতুন লোক আর আস্তে চায় না। কেননা কাজ কমে গেছে। কম্পুটার হয়ে কাজ কমে গেছে। কিছু কিছু জিনিস আছে ইস্কুল ডাইরি ফাইরি আছে এগুলো লাগে এগুলো এখানে হয়। খাতা পত্র একদমই শেষ হয়ে গেছে। নিত্যনতুন সব মেশিন বেরিয়ে, মানে, ম্যান পাওয়ার কমে গেছে। যার ১০ টা লোক লাগত তার ২ টো লোকেই হয়ে যাচ্ছে।

আমার ২ ছেলে আর স্ত্রী। যা কিছু করেছি এই লাইনে থেকেই করেছি। যদি মিথ্যা বলি ভুল। আগে পয়সা ছিল। ১৫ বছর আগে ১০ টাকায় যে কাজটা করেছি এখন ১৫ বছর বাদে মার্কেট, মানে, অনেক হাই হয়ে গেছে। তার দাম কমেছে আরও। তার দাম কমেছে। যদি বলেন করেন কেন – ঐ চলে যাচ্ছে। এখন বয়েস হয়ে গেছে আর অত ইয়ে নেই।

২ ছেলে। বড় ছেলে এম বি এ – আপনাদের ঐ কলগেটে চাকরি করে। আর ছোট ছেলে কম্পুটারে চাকরি করে। সংসারে আমার চিন্তা নাই। সংসারের জন্য আমায় টাকা দিতেই হবে এমন কোন ব্যাপার নেই।        

কেষ্টপুরে আমার ৩ টে ফ্ল্যাট আছে। মানে এখান থেকেই করেছি। এখান থেকে। আমাদের ৬ টা কারখানা আছে। 

     

 

নেপাল চন্দ্র দে (শ্রমিক, শান্তি বাইন্ডিং ওয়ার্কস, ৩৫বি, সূর্য সেন স্ট্রিট, কলকাতা-৯ )

 আমার বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী। এখানে আমি এসেছি খুব ছোটবেলায়। আমার বয়স যখন, আপনার, বার বছর তখন। আমরা পূর্ণবসতিতে এসেছি। সরকারে এনেছে আমাদের। সরকার আমাদের পূর্ণবসতি দিয়েছে। আমার বাপ-মা সব চলে এসেছে এখানে। এখানেই আমাদের বাড়িঘর। আমার বাড়ি চাকদা – রাণাঘাটের কাছে। আমাদের binding line টা খুব একটা খারাপ না, ভাল line। কিন্তু কথা হল শ্রমিকরা মার খাচ্ছে। শ্রমিকরা পয়সাকড়ি  দিনে… খুবই অল্প পয়সায় কাজ করতে হয়। এই যে আমার দেখছেন ৬৫বছর বয়স, তাতে এখনও আমার ৬৫… ৬৫ টাকা রোজে কাজ করি। বছরে মালিকরা কি পয়সা পায় না পায় জানি না। কিন্তু কথা হল বছরে যখন শ্রমিকরা পয়সা বাড়ানো… বাড়াতে বলা হয়, তখন তারা পারে না। তারা একই কথা বলে যে আমি পারছি না। সরকারের ঘরে binding বলতে কোন উল্লেখ নেই।  যে এই binding টা সারা ভারতবর্ষে চলে। হাসপাতাল বলুন, কোর্ট বলুন, ইস্কুল বলুন, কলেজ বলুন, সব কিছুই চলে। এই binding না হলে পরে কোন কিছুই চলবে না। অথচ binding  কোন উল্লেখ নেই সরকারের ঘরে । যার জন্য শ্রমিকরা মার খাচ্ছে। কোন পয়সা পয়সাকড়ি সেরকম কোন বাড়ছে না। মনে করুন, ৪০ টাকা, ৫০ টাকা, ৬০ টাকা, ৭০ টাকায় কখনও জল গরম হয়? রাজমিস্ত্রিদের মাইনে… তাদের মাইনে ৩০০ টাকা হয়ে গেছে… রাজমিস্ত্রিদের। অথচ আমাদের line এ ৩০০ টাকা কেন, কেউ ৭০ টাকা দিতে চায় না, যার জন্য আমাদের lineএ কেউ কাজ শেখে না। আগে অনেক বাচ্চাকাচ্চা পাওয়া যেত, কাজ শিখত। কিন্তু এখন কেউ আসেও না, কাজও শেখে না। এই line টা কি হবে জানিনা। কারণ আমরা… আমাদের বয়স তো হয়ে গেছে, আমরা আর কদিন থাকব? আমরা মরে গেলে পরে পরবর্তী যে line টা থাকবে কি না থাকবে সেত আমরা ভেবে পাচ্ছি না।

 

 

শিবু গোলদার (প্রধান কর্মী, উদয় বাইন্ডিং ওয়ার্কস, ৫৬ সূর্য সেন স্ট্রিট, কলকাতা-৯)

আমার নাম শিবু গোলদার। আমি থাকি বসিরহাট। বসিরহাট থেকে এখানে আসি। এখানে দীর্ঘ ৩৫ বছর কাজ করছি । এই বাইন্ডিং সম্পর্কে আমি অনেক কিছুই জানি। বাইন্ডিং-এর বর্তমানে যা কাজ হয় তার সবই মোটামুটি জানি। জানি, যথেষ্ট ভালই জানি। আমাদের দোকানে ফুরনে স্টাফ , মাইনে স্টাফ মিলিয়ে ১৭ জন লেবার কাজ করি। আমাদের এখানে ৯ জন পার্মানেন্ট, ৮ জন ক্যাজুয়াল স্টাফ ।

আমার একজন মাসি ছিলেন , উনি বাঙ্গুরে থাকতেন। আমার মালিকের শ্বশুরবাড়ি বাঙ্গুরে। আমার মাসি ঐ বাড়িতে কাজ করতেন। উনি বললেন আমার জামাইবাবুর ওখানে কাজ করবে? প্রেসের কাজ। আমি বললাম হ্যাঁ চেষ্টা করব। প্রথম অবস্থায় এসে ঢুকলাম , ঢোকার পর দেখলাম মাসি জানেও না এটা প্রেস না  বাইন্ডিং । আমি দেখলাম এখানে বাইন্ডিং-এর কাজ হয়। যথারীতি  এসে বাইন্ডিং-এর কাজে কি আছে সেটা দেখলাম। দেখার পর যখন আমি কাজে লাগি তখন আমার মাইনে ৯০ টাকা । ৮২ সালে আমি কাজে ঢুকি । ৯০ টাকা মাইনে থেকে এখন ৩৫-৩৬০০ টাকা মাইনে। এখানকার হাইয়েস্ট মাইনে আমার। সিবাস দা সবচেয়ে পুরনো , তারপর কার্ত্তিক দা । তারপর আর সবাই।

কাজের অভাব নেই,  তবে বর্তমান বাজারে যে পরিস্থিতি তাতে আধুনিক মেশিন বেরিয়ে আমাদের কাজের খুবই ক্ষতি করেছে।  আজ এমন মেশিন এসেছে যে মেশিন একা দশ’টা লোকের প্রোডাকসন করে দিতে পারে। বাইন্ডিং কারখানার লেবারের খুবই সংকটজনক অবস্থা। যে কাজটা ১৫ দিনে করতাম সেটা ৫ দিনে করে দিতে হচ্ছে ।

আজ থেকে ১০ বছর আগে মালিকের যা ইনকাম ছিল সে তুলনায় বর্তমানে তার ইনকাম কম। কিন্তু কাজ বাড়তি, তাতে হয়ত পুষিয়ে যায় । কিন্তু আগের পরিমাণে যদি কাজ এখন থাকত তাহলে মালিকের হিউজ ইনকাম ছিল । আমাদের মালিক নিজে কাজ করে।

এই মালিকের বাবা আমাদের সাথে ৯ টায় আসতেন আর ১০ টায় যেতেন । ইনি আসেন ২-৪ ঘন্টা কাজ করে চলে যান ।  লোক না থাকলে নিজে পুরো লেবার দেয়। এটাই মালিকের একমাত্র বিজনেস ।

বর্তমানে এ টাকায় আমাদের সংসার চলে না। বাড়িতে ছেলে, মেয়ে, বউ সবাই মিলে কাজ করে সংসার চালাতে হয় । পরিবারে  বাইন্ডিং  লাইনে আর কেউ নেই । ওয়াইফ  ঠোঙ্গা বানায়, ছেলে গ্যারাজে কাজ করে, মেয়ে লেখাপড়া করে । এইভাবেই আমাদের জীবনযাপন চলছে । মেয়ে যতদূর পড়তে চাইবে পড়াব । এখন এইটে  পড়ছে ।

আগে আমরা আঠা কড়ায় দিয়ে বানাতাম ঘরে বসে । কিন্তু এখন যে লেবারের প্রবলেম তাতে আঠা বানানো পোষায় না । আধুনিক আঠা কিনতে পাওয়া যায় সেই আঠাই আমরা ইউজ করছি । ম্যাক্সিমাম আঠা ইউজ হয় ফেভিকল । ড্রাই ফেভিকল মেসিনে ইউজ হচ্ছে ।

৩ বছর অন্তর অন্তর যখন এগ্রিমেন্ট হয়, যখন আমাদের মাইনে বাড়ানোর প্রশ্ন হয় তখন মালিক শ্রমিক সবাই মিলে আমরা যাই মালিকের কাছে । মালিকরা যায় পাবলিশারদের কাছে, গিয়ে তারা আন্দোলন করে । মাইনে বাড়ানোর সময়ে যোগাযোগ হয়, তারপর আর কোন সম্পর্ক থাকে না। কাজের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে মালিক আর পাবলিশারের সম্পর্ক । আমাদের সাথে সম্পর্ক নেই। আমরা তো লেবার।

বর্তমান যা মার্কেট তাতে দোকানে দোকানে ঘুরতে হয়।  ৫ পয়সা রেটটা ৩ পয়সায় করতে হয় কাজ নেওয়ার জন্য।  কিন্তু এই কারখানাটা গত ৭০ বছর ধরে একটা পাবলিশারের সাথেই ব্যবসা করছে । দরজায় দরজায় এরা কমই যায় । যেতে হয় না, বরং লোকে আমাদের কাছে আসে, যেহেতু আমরা মার্কেটে ঘুরি না। আমাদের কাজের নাম আছে। কিন্তু আমরা কাজ করে শেষ করতে পারি না। বর্তমান বাজারে সিজন হচ্ছে ৩ মাস। ৩ মাসের জন্য বহু দাদারা আসে খোঁজ করতে। তারপরে আর কাউকে পাওয়া যায় না। আগে ছিল মার্চ – এপ্রিল – মে , এখন হয়ে গেছে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ এই যে ৩ মাস নতুন বইএর ব্যাপারটা থাকে। এ সময়ে আমাদের খুব কাজের চাপ থাকে। ওরিয়েন্টালের কাজ করে ফাঁক পেলে অন্যের কাজ করি। আমাদের মতো বাইন্ডার ওদের  (ওরিয়েন্টাল)–এর আরও ৩ টে আছে। আমরা যতটা করি ওরাও ততটাই করে। বাঁধাই সবই হয় – কাগজ আনা, ভাজাই করা, ইন্টারলিফ করা, কাটিং করা, সবই আমরা করি। একটার পর একটা পাতা সাজানোকে বলে মিছেল টানা – ইংরাজিতে ইন্টারলিফ । কেউ কেউ গ্যাদারিং ও বলে।

আমরা যখন যুদ্ধ করতে যাই তখন  পাবলিশারের দরজায় যুদ্ধ করতে যাই । কিন্তু কেন যাব ? আমরা তো মালিক কে বলব। কিন্তু আমাদের ঠেলে দিচ্ছে । ছোট খাট জায়গায় মাইনে বাড়বে না, কারণ কাজ নেই – মাত্র ৩ মাস কাজ। ২০০ টাকা দিয়েও ১ টা লেবার নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তারপর সারা বছর কাজ চাইলে ১০০-১২০ টাকায় করতে বলবে। সিজনে ২০০/২২৫/২৫০ টাকায় কাজ হয়।

 

চায়না দেবনাথ (দৈনিক কর্মী, কালি বাইন্ডিং ওয়ার্কস, ৭২ বৈঠকখানা রোড, কলকাতা-৯)

প্রঃ আপনার নাম?

উঃ চায়না দেবনাথ।

প্রঃ আপনি কোথায় থাকেন?

উঃ হাবিবপুর।

প্রঃ আপনি রোজ হাবিবপুর থেকে আসেন?

উঃ হ্যাঁ।

প্রঃ আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

উঃ আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমার স্বামী আছেন।

প্রঃ আপনি এখানে কি ভাবে এলেন?

উঃ একজন ছেড়ে গেছে তার জায়গায় আমি এলাম।

প্রঃ আপনি এখানে ঠিক কি কাজ করেন?

উঃ আমি stitch করি। বইগুলি পিন করি।

প্রঃ শুধু এই কাজই করেন?

উঃ না সবই করি যখন দরকার থাকে।

প্রঃ আপনি কতদিন এখানে কাজ করছেন?

উঃ আমি এখানে প্রায় ১৫ বছর কাজ করছি।

প্রঃ আপনি যে এখানে কাজ করেন, সেটা কি হিসেবে করেন?

উঃ আপনি কি টাকা পয়সার কথা বলছেন ? আমি এখানে রোজের হিসেবে কাজ করি।

প্রঃ আসলে আপনাদের এখানে তো অনেক রকমের ব্যাপার আছে, যেমন কেউ কেউ ফুরনে কাজ করেন ইত্যাদি।

উঃ না না আমরা রোজের হিসেবে কাজ করি।

প্রঃ আপনি এখানে ১৫ বছর কাজ করছেন, কি কি চেঞ্জ দেখতে পান? কি কি পাল্টে গেছে বলে আপনার মনে হয় ?

উঃ আগে অনেক কাজ ছিল। আমরা সকাল ৯ টা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম। মাঝে মাঝে বাড়ি ও যেতাম না সারারাত থাকতাম nightshift করতাম। আমরা সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১ টা অবধি কাজ করতাম। তখন অনেক কাজ থাকত। এখন আর অত কাজ থাকেনা। মাঝে মাঝে বসেও থাকতে হয়।

প্রঃ আপনার কি মনে হয় কাজ কেন কমে গেছে?

উঃ কাজ কেন কমে গেছে সেটা ত আমি ঠিক বলতে পারবনা। কিন্তু কাজ এখন অনেক কমে গেছে।

প্রঃ এখানে আপনাদের মালিকের সঙ্গে আপনাদের কেমন সম্পর্ক ?

উঃ আমাদের মালিকের সাথে তো আমাদের খুবই ভাল সম্পর্ক।

প্রঃ উনি কি নিজেও কাজ করেন?

উঃ হ্যাঁ।

প্রঃ আপনি এখানে যা পান তাতে আপনার সংসার চলে যায় ?

উঃ না না আমার এই টাকায় কি আর সংসার চলে! ওই হাত খরচটা আর টুকটাক একটু help হয় যায়। বাড়িতে অন্য যারা আছেন তারাও কাজ করে।

প্রঃ আপনার চেনাজানা কেউ কি এই কাজ করেন?

উঃ হ্যাঁ।

প্রঃ এখন তো বাজারে অনেক রকমের মেশিন এসে গেছে। তা আপনার কখন মনে হয় না যে ওই মেশিনগুলি চালাতে শিখি এতে যদি আপনাদের রোজগারটা একটু বাড়ে ?

উঃ সে হয়ত বাড়তে পারে। কিন্তু এখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আসলে এখানে আমাদের মালিকের সঙ্গে আমাদের খুব ভাল সম্পর্ক। উনি আমাদের খুব help ও করেন। তাই আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবে মালিকের যদি অসুবিধে হয়, কোনদিন যদি কিছু বলে তখন হয়ত…

প্রঃ এই কাজে কি অনেক মহিলারা আছেন?

উঃ আসলে আমাদের তো বেশিরভাগ contract-এ নেয়…কাজ বেশি থাকলে তখন ডাকে…তবে আমি আর আরেকজন এখন একদম এখানে আছি।

প্রঃ রোজ কতগুলি বই আপনি করে ফেলেন?

উঃ এমনি তে আমরা রোজ সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করি…মানে ঠিক ১০ টায় কাজে বসে যাই…তারপর আমাদের ১ ঘণ্টা টিফিন থাকে…রোজ এরকম বই প্রায় ৫০০০ টা শেষ করি।

প্রঃ আপনি রোজ এখানে কি ভাবে আসেন?

উঃ আমি রোজ train- এ আসি… train-এ শিয়ালদহ এসে তারপর হেঁটে এখানে আসি।

 

সুদীপ ভট্টাচার্য (মালিক,উদয় বাইন্ডিং ওয়ার্কস, ৫৬ সূর্য সেন স্ট্রিট, কলকাতা-৯)

 সরকারের সাথে এমনিতে তো ভালোই সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, সরকারের বিভিন্ন নীতির ক্ষেত্রে আমাদের অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে অবশ্যই। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেমন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি নীতি যে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ছাত্রদের হাতে সরকার নিজে বিনামূল্যে তুলে দেবে। সরকার নিজেই সেটা বই ছাপবে এবং বই বাঁধাইও করবে এবং সেটা ছাত্রদের হাতে পৌঁছে দেবে। হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে আমরা একটা সংশয়ের মধ্যে অবশ্যই রয়েছি যে সরকার কী করবে, সরকার কাকে দিয়ে বাঁধাই করবে, এটা আদপে পশ্চিমবঙ্গে হবে না পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে করিয়ে আনা হবে ? এ ব্যাপারে সরকার সেভাবে এখনো কিছু যেহেতু খোলসা করে বলেনি… পরিষ্কার ভাবে বলেনি… যে কারণে আমাদের একটা সংশয়  আছে। যদি ঘটনাটা তাই হয়, তাহলে অবশ্যই এই শিল্প একটা সংকটের মধ্যে পড়বে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সরকারের… যত দূর আমি জানি যে সরকারের নীতি আছে যে স্কুল পাঠ্যবইয়ের বেশির ভাগটাই সরকার নিজেই নিয়ে নেবে। সে ক্ষেত্রে একটা বিশাল অংশের ব্যবসা সম্বন্ধে আমরা সন্দীহান হয়ে পড়ছি। প্রকাশকরা তো বটেই, এই binding শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছে তারাও বিশেষ চিন্তার মধ্যে রয়েছে। এখন আমরা… শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কাছে কোনো উপায় নেই। আমরা দেখছি যে ভবিষ্যতে কী দাঁড়ায়।

 

প্রবীর কুমার দে

(মালিক, সরস্বতী এন্টারপ্রাইস, ৩৫/এ/৩, বিপ্লবী বারীন ঘোষ সরণি,কলকাতা-৬৭

ইউনিয়ন নেতা,  বঙ্গীয় গ্রন্থন ব্যবসায়ী সমিতি )

 আমি বঙ্গীয় গ্রন্থন ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি। আমাদের ১৫০ জনের মত মেম্বার আছে, এই বাইন্ডিং মেম্বার এবং মেম্বার ছাড়া বলতে গেলে প্রায় ধরুন ৫০০ থেকে ৬০০ বাইন্ডিং কারখানা আছে। তারা আমাদের মেম্বার নয় অথচ তারা কিন্তু কাজ করছে। এবার যখন কোন প্রকাশকের কিছু অসুবিধে হয়, অসুবিধে বলতে হয়ত ধরুন যেমন বইএর হিসেব পাচ্ছেনা ঠিকমত, বই মেলাতে পারছেনা – তখন আমাদের কাছে প্রকাশক দ্বারস্থ হয়। আসে আমাদের কাছে, বলে – অমুক বাইন্ডার আমাকে এত বই  দেয় নি, রোজ আমরা যাতায়াত করছি, বলছি  তবুও বই দিচ্ছে না। তখন আমরা একটা কথাই প্রকাশক কে বলি, যে দেখুন আমাদের যদি মেম্বার হয় আমরা সেটা দেখব, আর মেম্বার না হলে আমরা কিছু করতে পারব না।

ধরুন এই শিল্প এখন বলতে গেলে সবথেকে কম পয়সার ব্যবসা এই binding শিল্পই আছে আমার তো বলে মনে হয়… এমন অনেক বাইন্ডিং কারখানা আছে যাদের কাটিং মেশিন নেই, স্টিচ মেশিন পর্যন্ত নেই। তারা করে কি ঐ বই ফর্মা ভেঁজে, মিছেল তুলে আমাদের মত কিছু কারখানা থেকে হয়ত বই কেটে নিয়ে গেল বা স্টিচ করে নিয়ে গেল – এইরকমভাবে তারা কারখানাগুলো চালাচ্ছে। এখন এদের সাথে তো আমরা competition করতে পারছি না। এখন তাদের ফ্যামিলি নিয়ে কাজ করছে, ঘুম থেকে উঠেই কাজ আরম্ভ করে দিচ্ছে, রাত ১২ টা নেই, ১ টা নেই, ২ টো নেই সারারাত নেই… এখন কিছু প্রকাশক এদের কাছে ছোট ছোট কারখানা ধরে নিয়েছে। ধরে নিয়ে দেখছে যে আমি একজায়গায় ৪০ হাজার বই দেব কেন আমি যদি ৪ টে জায়গায় ১০ হাজার করে ভাগ করে দিতে পারি… দিয়ে আমি তো ২ হাজার করে বই পেয়ে যাচ্ছি।  এবার ৪ জনের কাছে যে last-এ মালটা পড়ে থাকছে তখন ওরা ১টা জায়গাতে গলতিটা নিয়ে নিচ্ছে। নিয়ে, সেখান থেকে আবার বই তুলে নিচ্ছে। আর আমাদের, আমরা যেভাবে চালাচ্ছি কারণ আমাদের তো এখানে একটা লোকের মজুরি আছে, ৮ ঘন্টা শিফট আছে, তারপরে সারে চার ঘন্টার শিফট আছে, আবার রাত্রিবেলা কাজ করাতে গেলে তাদের খাবার পয়সা দিতে হয় –বিভিন্ন কিছু আমাদের নিয়মকানুন আছে।

আমাদের যেমন মেশিন প্রচুর এসে গেছে বা মেশিনে কাজ হচ্ছে, আবার এই মেশিন আসাতে হচ্ছে কি আমরা যেমন service  পাচ্ছি আবার অনেকসময়ে আমাদের অসুবিধে হয়ে যাচ্ছে – এই মেশিন যারা চালায় আমাদের বাঙালি ছেলেরা কেউ কাজ শিখছেনা। এই লোকগুলো সাধারনত ওই ডালখোলা মানে সব ঐ north Bengal- এর দিক থেকে আসে। এবং এরা বাড়ি যায় ৭ দিনের নাম করে, আসবে ১ মাস পর। আজকে ধরুন আমার ফোল্ডিং মেশিন আছে তা সত্বেও আমি হাতের লোক রেখেছি কেন? জানি যে লোক বাড়ি গেলে ও ৭ দিনের বলবে, আসবে ১ মাস পর। কিন্তু আমাকে তো প্রকাশক কে বই দিতে হবে। প্রকাশক তো আমাকে ছাড়বে না! এখন প্রকাশকরা সবকিছু  আমাদের কাঁধে বন্দুক রেখে কাজ করবে। আমরা কিন্তু… প্রকাশকের হৃদপিণ্ড আমরা। আমরা বইটা প্রেস থেকে ছেপে এসে, এল যখন আমরা সেই বইটাকে রাত দিন জেগে কাজ করে আমরা প্রকাশকের টেবিলে বইটা তুলে দিচ্ছি। এমন কিছু প্রকাশক আছে যে প্রতি year-এ কোন টাকা মেটায় না, বাকি ১ বছরে পড়ে থাকে।   তার কারণ কোন প্রকাশক বলবে কি যে আমার ঘরে ৪০ হাজার টাকার মাল পড়ে আছে, কে বলবে ৫ লাখ টাকার মাল পড়ে আছে,  কে বলবে ১০ লাখ টাকার মাল পড়ে আছে, আপনি আমার কাছে ২ লাখ টাকা পাবেন বিশ্বাস করতে পারছেন না? কিন্তু সেই টাকা না পেলে আমি তো ব্যাঙ্কের লোন দিতে পারব না বা লোকজনদের  দিতে পারব না। কিন্তু সেটা তো প্রকাশক বুঝছে না। আর প্রকাশক চায় কি য সে নিজে কোন গোডাউন করবে না, সে সমস্ত আমাদের এই বাইন্ডিঙের অপর ঘাড়েতে আমাদেরই ঘরগুলো নিয়ে সে ব্যবহার করছে। যেমন ধরুন একটা ১০ হাজার জীবন বিজ্ঞান বই ছাপল, গেল ৫ হাজার। এই ৫ হাজার আমাকে ১ বছর রেখে দিতে হবে। এবার ঐ ৫ হাজার বইতে যদি কোন উঁই লাগে বা ড্যাম খায় আমাকে প্রকাশককে ড্যামারেজ চার্জ দিতে হবে। এবার এই সামান্য ন্যুনতম রেটে কাজ করে আমাকে  যদি প্রকাশককে ড্যামারেজ চার্জ দিতে হয় তখন আমরা যাবো কোথায় ? ওরা আগে কাগজওয়ালা কে দেবে টাকা, প্রেস কে দেবে, আর্টিস্ট কে দেবে, ডি টি পি কে দেবে তারপর শেষে যা টাকা পড়ে থাকবে তখন আমাদের পেমেন্ট হবে। বলবে এ সপ্তাহে হল না , আপনি আগামি সপ্তাহে আসুন। তবে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কিছু প্রকাশক আছে যে তারা ডেকে বাইন্ডারদের টাকা মিটিয়ে দেয় এবং তারা মনে করে  যে বাইন্ডারস হচ্ছে আমার হৃদপিণ্ড এবং বাইন্ডারস কে আমরা আগে টাকা দেব। সেটা কিন্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজন।

আগামি দিনে এই শিল্প বাঁচাতে গেলে প্রকাশকদের আমাদের দেখতে হবে কারণ প্রকাশক যেভাবে রেট আমাদের ধার্য করে আমরা তার ওপর আমাদের স্টাফদের রেট ধার্য হয়। এখন মার্কেট-এর যা প্রাইস বুঝতে পারছেন তাতে আমরা যা ওদের বর্তমান মজুরি দিচ্ছি তাতে ওদের চলছে না কারণ ওরা বলছে যে আমরা এই শিল্প থেকে যদি অন্য শিল্পে যাই আমরা বেশি পয়সা রোজগার করতে পারব।

 

আফসার আহমেদ (সাহিত্যিক ও দপ্তরিপাড়া বিশেষজ্ঞ)

 ন’এর দশকের গোড়ার দিকে, আশির দশকের শেষের দিকে এই ঘটনাবলির সঙ্গে আমি সম্পর্কিত হই। তো, আমার কাছে খুব বিস্ময় লাগে যে, এই যে ওয়ার্ড, এটা যেন ইতিহাস বহন করে নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। অতীত মানুষ এখানে বসবাস করছে যেন। কারণ, কলকাতা শহরের যে পরিবর্তন সেই পরিবরতনের সঙ্গে এই ওয়ার্ড-এর পরিবর্তনের অসাম্য এতই বেশি যে এই সব মানুষগুলোর চেহারা এবং জীবনযাপন এতই নিষ্প্রভ, এতই মলিন যে কলকাতা শহরের অনান্য ওয়ার্ডগুলোকে কিছুতেই মেলানো যায় না।  আমার খুব বিস্ময় লাগত এইসব মানুষদের জীবন, জীবিকা… জীবিকা সূত্রে যে জীবন সেখানে যেন এই ওয়ার্ডটা যেমন অনালোকিত, মলিন তেমনই এদের জীবনযাপনও খুব অনুজ্জ্বল, মলিন। কারণ মানুষের শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে কষ্ট তারা বহন করছে, যে কষ্ট তারা সহন করছে, সেটা আমার কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হয়েছে।  আমি তাদের সমস্ত কিছু জেনেছি, বুঝেছি। তো, এই দপ্তরিপাড়ার জীবনে, ইতিহাসে… আমি যে মৌখিক ইতিহাস আমি পেয়েছি সেটা হচ্ছে যে ইংরেজ আমলের সূচনা লগ্ন থেকে যে মুসলিম জীবন… মুসলিমরা যেভাবে একসময়ে তারা ইংরেজ বিরধিতা করেছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে,  ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে ফলে তারা অনেক সুযোগসুবিধার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অনগ্রসরতা তাদের জীবন-জীবিকাকে নির্দিষ্ট করেছিল। পূর্ব নির্দেশ যেন ছিল এই জীবনযাপনের জন্যে, এই জীবিকার জন্যে।